আমি শিখি; আপনি?
'...ছন্দ-যতিচিহ্ন-অন্বয় না-জানা কিছু কবিতামুদ্রণখোর কচিকাঁচা-দরকচা
আছেন, তেমনই আছেন কিছু ভীমরতিপ্রাপ্ত, রতিবর্জিত ও অসার ক্ষুধান্দোলনজাত
প্রাক্তন কবিও।'
উদ্ধৃতাংশটি হয়তো আপনাদের কারও কারও চোখে পড়ে
থাকবে। যাঁদের চোখে পড়েনি, তাঁরাও এখন মনোযোগ দিতে পারেন। গতকাল 'কবি সুতপা
সেনগুপ্তের সঙ্গে ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের গোপন সম্পর্ক বিষয়ে মীমাংসা' শীর্ষক
পোস্টে আমি একথা লিখেছিলাম।
মাননীয় প্রতিবাদীগণ, আপনারা প্রায় কেউ
নিশ্চয়ই বোঝেননি, যে, 'কিছু ভীমরতিপ্রাপ্ত, রতিবর্জিত ও অসার
ক্ষুধান্দোলনজাত প্রাক্তন কবিও' বলতে আমি কী ইঙ্গিত করেছিলাম, তাই তো? হয়তো
পুরোনো ও মেধাবী কেউ বুঝে থাকবেন। তবে, অধিকাংশ হুজুগে তরুণ প্রতিবাদীই যে
বুঝবেন না, এটা আমার কাছে প্রত্যাশিতই। এর সহজ কারণ, এঁরা পড়েন না; বাংলা
কবিতার ধারা বা ইতিহাস কিছুই জানেন না। এঁদের আমি 'ছন্দ-যতিচিহ্ন-অন্বয়
না-জানা কিছু কবিতামুদ্রণখোর কচিকাঁচা-দরকচা' অভিধায় সসম্মান ভূষিত করেছি।
এঁরা এসব জানলে, বুঝলে আমাকে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করতেন। এবং, সজ্ঞানে জানাই,
এই দ্বিতীয় আক্রমণটি ঘটলে আমার ভালো লাগত। বুঝতাম, তরুণরা খবর রাখেন,
পড়েন, খানিক অধ্যয়ন করার প্রতি আগ্রহী। দুর্ভাগ্য, তা ঘটল না।
এখন, প্রশ্ন হল, আমার ইঙ্গিতটি কী ছিল?
ভীমরতিপ্রাপ্ত
রতিবর্জিত
ক্ষুধান্দোলনজাত
এই তিনটি শব্দই ছিল মূল সংকেত। প্রথম শব্দটি থেকে সহজ অর্থে এলে দাঁড়ায়,
যাঁদের ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাঁরা বেশ বয়স্ক। দ্বিতীয় শব্দটি মজা করে বলা,
বয়স্ক মানুষের রতিকর্ম থাকবে না, এটাই সাধারণভাবে স্বাভাবিক, কিন্তু,
যৌনতার আগ্রহ তো সজাগই থাকে, তাই না? শব্দগুলোর মধ্যে তৃতীয় শব্দটিই
সুনির্দিষ্ট সংকেত দেয়। কী? শব্দটিকে ভাঙলে কী পাই? ক্ষুধা, আন্দোলন ও জাত।
অর্থাৎ, ক্ষুধা-সংরক্ত আন্দোলন থেকে উৎসারিত। এবার হয়তো ধরতে পেরেছেন, যে,
আমি ষাটের দশকের বিখ্যাত হাংরি মুভমেন্টের কথা বলছি। তাহলে, বোঝাই গেল,
সেই আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন বা সেই আন্দোলনের এজেন্ডা অনুযায়ী যে
আকর্ষণীয় কাব্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার কুশীলবদের প্রতিই আমার ইঙ্গিত।
কিন্তু, এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। আমি কি তাঁদের সকলের কথা বলতে চেয়েছি?
না। এক, শুধু কবিদের কথা বলেছি। দুই, সব কবিদের নয়, তাঁদের মধ্যে যিনি বা
যাঁরা বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত সুতপা সেনগুপ্তের প্রতি-মন্তব্যে সাংঘাতিক
প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, আমি আরও নির্দিষ্ট করে তাঁর বা তাঁদের কথাই বলেছি।
কে বা কে কে এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন? যাঁর পোস্ট আমার চোখে পড়েছে,
তিনি শ্রদ্ধেয় মলয় রায়চৌধুরী। চেনেন নাকি তাঁকে, জানেন? পড়েছেন তাঁর
কোনও লেখা? বেশ, এই পোস্টের শেষে তাঁর একটি কবিতা দিচ্ছি, পড়ুন। তবে, তাঁকে
কেন আমি 'প্রাক্তন কবি' বললাম বা কে তাঁদের আন্দোলন আমার কাছে 'অসার', সে
দীর্ঘ আলোচনা বারান্তরে হতে পারে।
কথা হল, আপনারা অধিকাংশই এসব
বোঝার মতো অবস্থায় না পৌঁছলেও, স্বয়ং মলয় রায়চৌধুরী আমার পোস্ট খেয়াল
করেছেন, পড়েছেন। আপনারা হলে, কী করতেন? প্রতিবাদের নামে হাল্লা মাচাতেন, দল
পাকিয়ে নিজেদের আরও মূর্খ ও নীচ প্রমাণ করার জন্যে গুলতানি করতেন, তাই না?
আমার কাছে শিক্ষা এই, যে, মলয়বাবু এসব করলেন না। আসলে, এসব করার কথাও নয়।
আর, ঠিক এখানেই ওঁদের উচ্চতার মানুষ ও মননের সঙ্গে পার্থক্য আমাদের। আমার
মনে হয়, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আদর্শ প্রকৃত অর্থেই অনুধাবন করতে
পেরেছেন, যা আমাদের কাছে এখনও অধরাই। আমার গতকালকের পোস্টে দেওয়া
বিদ্যাসাগরের একটি প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে আবার উদ্ধার করছি:
'প্রতিবাদী মহাশয়েরা স্ব স্ব উত্তরপুস্তকে বিস্তর কথা লিখিয়াছেন; কিন্তু,
সকল কথাই প্রকৃত বিষয়ের উপযোগিনী নহে। যে সকল কথা প্রকৃত বিষয়ের উপযোগিনী
বোধ হইয়াছে, সেই সকল কথার যথাশক্তি প্রত্যুত্তর প্রদানে প্রবৃত্ত হইলাম।
আমি এই প্রত্যুত্তর প্রদান বিষয়ে বিস্তর যত্ন ও বিস্তর পরিশ্রম করিয়াছি।
পাঠকবর্গের নিকট বিনয়বাক্যে প্রার্থনা এই, তাঁহারা যেন, অনুগ্রহ প্রদর্শন
পূর্ব্বক, নিবিষ্ট চিত্তে, এই প্রত্যুত্তর পুস্তক অন্ততঃ এক বার আদ্যোপান্ত
পাঠ করেন, তাহা হইলেই আমার সকল যত্ন ও সকল শ্রম সফল হইবেক।'
(বিধবাবিবাহ, দ্বিতীয় পুস্তক)
মলয় রায়চৌধুরী আমার পোস্টে কোন বিষয়ে কী কমেন্ট লিখলেন, তা সঙ্গের ছবিতে (স্ক্রিনশট) দেখুন। এবার, আসুন, তাঁর একটি কবিতা পড়া যাক:
______
নখ কাটা ও প্রেম
রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে:
কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভূঁইয়ে--
সেই বিদেশিনী? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা?
যুবতীরা আপনার হাতখানা কোলের উপরে নিয়ে নখ
কেটে দিচ্ছেন, এরকম ফটো কেউ তোলেনি যে!
ওকাম্পোর হাঁটুর উপরে রাখা আপনার দর্শনীয় পা?
মহত্মা গান্ধীর দুই ডানা রাখবার সাথিনেরা
বোধহয় কেটে দিত নখ; কেন-না বার্ধক্যে পৌঁছে
নিজের পায়ের কাছে নেইলকাটার নিয়ে যাওয়া, ওফ, কী
কষ্টকর, আমার মতোন বুড়ো যুবতী সঙ্গীহীন পদ্যলিখিয়েরা
জানে; প্রেম যে কখন বয়সের দাবি নিয়ে আসে!
ফিসফিসে-লোকে বলে সুনীলদার প্রতিটি নখের জন্যে
উঠতি-কবিনী থাকে এক-একজন। জয় গোস্বামীরও
ছিল; তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমুদ্রের পাঁকে চোখ বুজে।
চাইবাসার ছোটোঘরে শক্তিদার নখ কেটে দিচ্ছেন প্রেমিকাটি
দেখেছি যৌবনে। বিজয়াদিদির নখ কেটে দেন কি শরৎ?
যশোধরা, তোর নখ কেটে কি দিয়েছে তৃণাঞ্জন কখনও?
সুবোধ, আপনি নখ কেটে দিয়েছেন মল্লিকার পা-দুখানি
কোলের উপরে তুলে? কবি কত একা টের পেতে তার পা-এ
তাকালেই বোঝা যায়। যেমন জীবনানন্দ, হাজার বছর
খুঁজে চলেছেন কোনো এক বনলতা নখ কেটে দিয়ে যাবে
তাঁর...
______
আবার কবির পায়ের দিকে তাকাই আমি।